#বর্বরীক
আজকের এই 'প্রবন্ধ' (?)-র অবতারণা করছি, একটি বিশেষ আখ্যানকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ধারণা, এই ধারণার সূত্রপাত এবং এর স্বপক্ষে ও বিপক্ষে থাকা পৌরাণিক ও মহাকাব্যিক প্রমাণের অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে। বলা বাহুল্য, বহুদিন এই গ্ৰুপেও এই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং আজকের দিনটিও ব্যতিক্রম নয়।
আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মহাভারতের একজন প্রায় অখ্যাত বীর বর্বরিককে নিয়ে। এই বর্বরিক চরিত্রটি মূল বৈয়াসকী মহাভারতে নেই। দক্ষিণ ভারতে এর পরিচয় হল এক শাপভ্রষ্ট যক্ষ। যে এতবড় বীর ছিল, যে সে যোগ দিলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সমীকরণ বদলে যেত। তাই সে যুদ্ধে যোগ দেয়নি বা বলা ভালো যুদ্ধে তাকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র দর্শক হয়ে থেকে যায় এই মহাযোদ্ধা। নেপালে ইনি আকাশ ভৈরব নামে পূজিত হন। রাজস্থানে এঁর পুজো হয় খাটুশ্যামজি নামে।
বর্বরীকের কাহিনী মোটামুটি সবাই জানেন হয়তো, তবুও একবার বলে নিই। ভীমের পৌত্র এবং ঘটোৎকচের পুত্র ছিলেন বর্বরীক। তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করে স্বয়ং মহাদেবের সুপারিশে অগ্নির কাছ থেকে তিনি লাভ করেন তিনটি বাণ। অদ্ভুত অমোঘ এই অস্ত্র। প্রথম বাণ যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্ত শত্রুকে চিহ্নিত করে। দ্বিতীয় বাণ চিহ্নিত করে তাদের, যাদের ক্ষতি করতে চান না যোদ্ধা। তৃতীয় বাণ সমস্ত চিহ্নিত শত্রুর বিনাশ করে। এই তিন বাণ সঙ্গে নিয়ে ঠিক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বমুহূর্তে বর্বরিক এসে উপস্থিত হন পাণ্ডব শিবিরে।
পাণ্ডব শিবিরে তখন ঘোর দুশ্চিন্তার সময়। রথী-মহারথীরা পরস্পর পরস্পরকে জিজ্ঞেস করছেন, সমগ্ৰ কৌরবসৈন্যকে ধ্বংস করতে তাঁদের কার কতদিন লাগবে। যোদ্ধারাও নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ঘোষণা করছেন; কেউ শত্রুপক্ষ বিধ্বংস করতে সময় নেবেন পাঁচদিন, কেউ দশদিন, কেউ পনেরোদিন, কেউ বা একমাস, দু'মাস। কিন্তু বর্বরীক অম্লানবদনে ঘোষণা করলেন তিনি এক নিমেষেই সমগ্র কৌরবসেনা ধ্বংস করতে পারেন।
পাণ্ডবপক্ষে তো ব্যাপক চাঞ্চল্যের সূত্রপাত হল। ছোকরা বলে কী? 'ছোকরা'কে পরীক্ষা করতে এগিয়ে এলেন টিমের মেন্টর স্বয়ং বাসুদেব কৃষ্ণ। শুক্লপক্ষের দ্বাদশীর দিন এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে গিয়ে কৃষ্ণ দেখতে চাইলেন ওই অস্ত্রের শক্তি। তিনি বললেন, বর্বরীকের তপস্যা ও অস্ত্রপ্রাপ্তির কথা তিনি শুনেছেন, এখন তাঁকে অস্ত্র চালাতে বললেন তিনি। অবাক হয়ে বর্বরীক বললেন, “এখানে শত্রু কোথায়?” কৃষ্ণ তখন একটি অশ্বত্থ গাছের সমস্ত পাতাকে শত্রু বিবেচনা করতে বললেন। বর্বরীক অস্ত্রের ধ্যান শুরু করতেই কৃষ্ণ তাঁর অলক্ষে একটি পাতা ছিঁড়ে নিজের বাঁ পায়ের নিচে লুকিয়ে রাখলেন। বর্বরিকের তীর যথারীতি সব পাতাকে ছেদ করে গিয়ে বিঁধল কৃষ্ণের পায়ে। তাতে বর্বরিক ব্যস্ত হয়ে উঠতে কৃষ্ণ বললেন তীরের দোষ নেই উনি জানতে চেয়েছিলেন এই তীরের হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় আছে কি না। তাতে বর্বরীক উত্তর দিলেন, “আমার অস্ত্র অমোঘ। এর থেকে বাঁচার কোনো রাস্তা নেই। কিন্তু হে ব্রাহ্মণ! এই পা টি আপনি একটু যত্নে রাখবেন। আমার অস্ত্রের আঘাত বিফল হয় না।”
এইবার কৃষ্ণ স্বরূপ ধারণ করে বর্বরীককে অনুরোধ করলেন, তাঁর পিতৃ-পিতামহের পক্ষাবলম্বন করে কৌরবদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে। আর বর্বরীকের উত্তর শুনেই চমকে উঠলেন তিনি।
বর্বরীক কেবল তিনটি মন্ত্রপূতঃ বাণ ই সঙ্গে আনেননি, সেইসঙ্গে এনেছিলেন তাঁর মায়ের সামনে করা একটি প্রতিজ্ঞা। যুদ্ধে যে পক্ষ দুর্বল সবসময় তাঁকে লড়তে হবে সেই পক্ষের হয়েই। তবে এতেও পাণ্ডবদের চিন্তার কারণ ছিল না। কারণ গাণিতিক ভাবে পাণ্ডবপক্ষই দুর্বল। এগারো আর সাতের অনুপাত সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে। তাই বর্বরীকের এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে পাণ্ডবপক্ষের সবাই ভীষণ খুশি, তাঁরা মনে করতে শুরু করলেন কম সৈন্য থাকাটা বোধহয় শাপে বর হয়ে এল তাঁদের কাছে। মানে প্রায় সবাই। শুধু কৃষ্ণ ছাড়া।
কৃষ্ণই ওই প্রতিজ্ঞার আসল স্বরূপ ধরতে পেরেছিলেন। দুর্বল আর সবল পক্ষ একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। তিনি বর্বরীককে বোঝালেন যে যুদ্ধে দুর্বল পক্ষ একটি আপেক্ষিক সত্য। বর্বরীকের মত বীর যে পক্ষে যোগ দেবে সেই পক্ষ কিছুক্ষনের মধ্যে শক্তিশালী হয়ে উঠবে অন্য পক্ষ দুর্বল। তাতে বর্বরীক বাধ্য হবে পক্ষ পরিবর্তন করতে। এইভাবে শেষে পুরো যুদ্ধ ক্ষেত্রে একা বর্বরীক বেঁচে থাকবে, আর কেউ নয়। বর্বরীকও বিষয়টার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলেন আর এর সমাধান জানতে চাইলেন স্বয়ং কৃষ্ণের কাছেই। তাতে কৃষ্ণ বললেন এর সমাধান হল যুদ্ধে যোগ না দেওয়া। এতে কিন্তু বর্বরীক সম্মত হলেন না। তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট, ভবিষ্যৎ কাল এতে মনে করবে তিনি কাপুরুষ। তাই যুদ্ধে যোগ না দেয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
এর পর কৃষ্ণ অনন্যোপায় হয়ে দক্ষিণা হিসাবে চেয়ে বসলেন বর্বরিকের মস্তক, কারণ একমাত্র এভাবেই প্রভুর কর্মে-বীরের ধর্মে বিরোধ মেটানো সম্ভব। তাতে অবশ্য সেই মহাবীর খুশিই হলেন। তাঁর মনে হল এই-ই সঠিক সমাধান। তিনি নিজের হাতেই নিজের মাথা কেটে কৃষ্ণকে অর্পণ করলেন। কেবল শিরশ্ছেদ করার আগে দুঃখ করে তিনি বললেন যে তাঁর বড় সাধ ছিল যে, তিনি এই মহাযুদ্ধের সাক্ষী থাকবে। কৃষ্ণ আশীর্বাদ করলেন, বর্বরীকের এই কাটা মুন্ড যুদ্ধ অবধি জীবিত থাকবে। এবং তিনি এও নির্দেশ দিলেন যে এই মুন্ডকে যেন কুরুক্ষেত্রের সবচেয়ে উঁচু স্থানে রাখা হয়। যেখান থেকে পুরো যুদ্ধক্ষেত্র দেখা যাবে। তাই করা হল।
এবার যুদ্ধের শেষের পর এক সমস্যা এসে উপস্থিত। ভীম এবং অর্জুনের অনুচরেরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করল কে বেশি শত্রু হত্যা করেছে এই নিয়ে। দুপক্ষ সমাধানের জন্য গেল কৃষ্ণের কাছে। তাতে বাসুদেব বললেন তিনি যেহেতু সর্বদা অর্জুনের সাথে ছিলেন তাই তিনি এর সমাধানে অক্ষম। কিন্তু তিনি জানেন কে এর সমাধান করতে পারবে। বর্বরীক। সেই একমাত্র নিরপেক্ষ দর্শক। কাজেই সবাই এসে উপস্থিত হল সেই মহাবীরের কাটা মুন্ডুর কাছে। প্রশ্ন শুনে বর্বরীক হাসতে শুরু করেন। তারপর বলেন, “এককথায় এর উত্তর দেয়া যায় না। বরং আমি যুদ্ধক্ষেত্রে কি দেখেছি তাই বলি।
আমি দেখেছি অর্জুনের তীর বা ভীমসেনের গদা শত্রুর প্রাণ নেয়ার আগেই কৃষ্ণের চক্র শত্রুর সংহার করে ফেলেছে। আমি দেখেছি পুরো রণক্ষেত্রে মাতা দ্রৌপদী মা মহাকালী রূপ নিয়ে শত্রুর রক্তপান করছেন।"
ঝগড়ার সমাপ্তি হল। কৃষ্ণের নির্দেশে মানস সরোবরে রক্ষিত বর্বরীকের বাকি দেহ আনা হল। অশ্বিনীকুমারদ্বয় কৃষ্ণের নির্দেশে সেই মাথা আর দেহ আবার জুড়ে দিলেন। নিজের সম্পূর্ণ দেহ ফিরে পেয়ে বর্বরিক জানালেন যে, এই যুদ্ধ দেখে তাঁর সংসারে আসক্তি নাশ হয়েছে। তাই তিনি বাকি জীবন হিমালয়ে তপস্যা করে কাটাতে চান। সবার আশীর্বাদ নিয়ে বর্বরিক বেরিয়ে পড়লেন হিমালয়ের উদ্দেশ্যে।
এই সব বিভিন্ন লোকগাথা ছাড়া পৌরাণিক ভাবে এর উল্লেখ পাওয়া যায় স্কন্দপুরাণেও। স্কন্দপুরাণের মাহেশ্বরখণ্ডের কুমারিকা-খণ্ডের বর্ণনাতেও পাওয়া যায় বর্বরীক ভীমের নাতি এবং ভীম-হিড়িম্বার ছেলে ঘটৎকচের পুত্র। ঘটোৎকোচের বিয়ে হয় নরকাসুরের প্রধান সেনাপতি মুর বলে এক দৈত্যের কন্যা কামকটঙ্কটার সাথে। এই কামকটঙ্কটা দেবী কামাখ্যার কাছ থেকে অজেয় খেটক ও খড়্গ (ঢাল-তরবারি) লাভ করে যুদ্ধে অপরাজেয় হয়ে ওঠেন। নরকাসুরের সঙ্গে কৃষ্ণের যুদ্ধকালে ইনি কৃষ্ণকে আক্রমণ করেন ও কেবল তাঁর খড়্গ দ্বারাই কৃষ্ণের শার্ঙ্গধনু-নিক্ষেপিত শরজাল ছিন্ন করে গরুড়ের মাথায় খড়্গাঘাত করে তাকে অজ্ঞান পর্যন্ত করে ফেলেন। শেষ পর্যন্ত দেবী কামাখ্যার মধ্যস্থতায় কৃষ্ণ ও কামকটঙ্কটার যুদ্ধের ইতি ঘটে। নরক-মুরুর মৃত্যুর পর নরকপুত্র ভগদত্ত রক্ষিত প্রাগজ্যোতিষপুরেই কামকটঙ্কটা বসবাস করতে থাকেন। এহেন বীর, কীর্তিমতী ও রূপসী কন্যার যে বহু পাণিপ্রার্থী জুটবে, তা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কাজেই তিনি বিবাহেচ্ছুক পুরুষদের প্রতি এক শর্ত আরোপ করেন, যে পুরুষ তাঁর সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে এবং বীরত্বেও তাঁর সমকক্ষ হবে, তাকেই তিনি পতিরূপে বরণ করবেন। ঘটোৎকচ কৃষ্ণের নির্দেশে কামকটঙ্কটার সকল শর্ত অতিক্রম করে তাঁকে বিবাহ করেন। এহেন মাতা-পিতার পুত্র বর্বরীক যে জন্মমাত্রেই মহাবীর হয়ে উঠবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি? স্কন্দপুরাণ বর্বরীকের বর্ণনা দিয়েছে এই বলে- “নীলমেঘরাশিবৎ সেই সন্তানের বদনমন্ডল ঘটতুল্য এবং লোচনযুগল দীর্ঘ। সে ঊর্দ্ধকেশ ও ঊর্দ্ধরোমা।” রাক্ষসযোনির নিয়মমতো জন্মেই যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে পিতা-মাতাকে প্রণাম করে সেই পুত্র তার নাম প্রার্থনা করলে তার বর্ব্বরাকার কেশগুচ্ছ (বাবরি চুল) দেখে ঘটোৎকচ তাঁর নাম দেন বর্বরীক- বর্ব্বরাকারকেশত্বাদ্বর্বরীকাভিধো ভবান্। বর্বরীকের জন্মের কিছুদিন পরে ঘটোৎকচ তাকে সঙ্গে করে দ্বারকায় কৃষ্ণের কাছে গেলে বর্বরীক কৃষ্ণকে শ্রেয়ঃসাধনের উপায় জিজ্ঞেস করে। কৃষ্ণের পরামর্শেই বর্বরীক অতুল বললাভের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে মহীসাগরসঙ্গমতীর্থে জগতের সকল দেবীর আরাধনা করতে যায়। সেই তীর্থে অবস্থানরতা দেবীরা তাকে বলেন, কিছুকাল পরে বিজয় নামক এক মগধদেশীয় ব্রাহ্মণ এখানে আসবেন; তিনি পদব্রজে সমগ্ৰ পৃথিবী পরিভ্রমণ করেছেন ও কাশীতে সাধন-সম্বন্ধীয় বিশেষ বিদ্যা অর্জন করে এখানে আসছেন। তিনি গুহেশ্বর প্রমুখ সপ্তলিঙ্গের অর্চনা করে সিদ্ধিলাভের জন্য বহুকাল দেবীদের উপাসনা করেন এবং দেবীরা তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে বলেন, মহীসাগরসঙ্গমতীর্থে ঘটোৎকচপুত্র বর্বরীক কর্তৃক রক্ষিত হয়ে যদি তিনি সিদ্ধমাতার সাধনা করেন, তবে তিনি সিদ্ধিলাভ করতে পারবেন। দেবীরা বর্বরীককে এও বলেন, এই ব্রাহ্মণকে সাহায্য করলে তার প্রভূত উপকার সাধিত হবে। বর্বরীক দেবীদের আদেশে সারারাত সশস্ত্র অবস্থায় জাগ্রত থেকে ও বহু অসুর বধ করে ব্রাহ্মণের যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে সাহায্য করেন। এতে অত্যন্ত খুশি হয়ে বিজয় নামক সেই ব্রাহ্মণ তাঁর যজ্ঞবেদীতে পড়ে থাকা সিঁদুরবর্ণ ছাই বর্বরীককে প্রদান করেন ও বলেন, যুদ্ধের সময় এই ছাই শত্রুদের ওপর ছড়িয়ে দিলে তার শত্রুদের দেহ বিধ্বস্ত হবে, যে যে অঙ্গে এই ছাই স্পর্শ করবে, সেই অঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়বে এবং শত্রুরা মৃত্যুমুখে পতিত হবে। বর্বরীক তাঁর কাজের বিনিময়ে কোনো দান গ্ৰহণ করতে অস্বীকার করলে দেবতারা তাকে বলেন, ভবিষ্যতে যখন কুরু-পাণ্ডবের মহাসংগ্ৰাম ঘটবে, তখন এই অমোঘ যজ্ঞভস্ম যদি কোনোরকমে কৌরবদের হাতে পড়ে, তবে মহা অনর্থ ঘটবে; তার চেয়ে এই-ই ভালো হবে যে বর্বরীকই যদি এই ছাই গ্ৰহণ করে। দেবতাদের নির্দেশকে সম্মান জানিয়ে বর্বরীক বিজয়ের কাছ থেকে এই ভস্ম গ্ৰহণ করে ও মহীসাগরতীর্থেই ভক্তিপূর্ণ চিত্তে দেবীগণের আরাধনায় জীবন অতিবাহিত করতে থাকে।
এ সময়েই অনুষ্ঠিত হয় দ্যূতসভা ও পাণ্ডবদের বনবাস। বনবাসকালে ভীম সহ পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী পথশ্রমে ক্লান্ত একসময় এই মহীসাগরতীর্থের ঈশানকোণস্থ চণ্ডিকা-মন্দিরে আশ্রয় গ্ৰহণ করেন। সেখানে চণ্ডিকার পূজারী বর্বরীকও উপস্থিত ছিলেন (খেয়াল করে দেখুন, চণ্ডিকার পূজারী এমন একজন, যিনি জন্মসূত্রে রাক্ষস), কিন্তু জন্মের পর থেকে বর্বরীকের সঙ্গে পাণ্ডবদের সাক্ষাৎ না হওয়ায় তাঁরা কেউই কাউকে চিনতে পারলেন না। এই সময় ভীম এই মন্দিরের কুণ্ডে স্নান ও জলপানার্থ অবগাহন করতে উদ্যত হলে বর্বরীক তাঁকে নিষেধ করে বলেন, জল নিয়ে কুণ্ডের বাইরে এসে পঞ্চাঙ্গ প্রক্ষালন করতে। কিন্তু ভীম বর্বরীকের বারণ না শুনে কুণ্ডের ভেতরেই দেহমল নিক্ষেপ করলে বর্বরীক ক্রোধে অন্ধ হয়ে বলেন, “আমি এই জলে দেবীকে প্রত্যহ স্নান করাই, তুমি সেই জলেই দেহমল নিক্ষেপ করলে? এ কেমন ব্যবহার? তুমি অতি দুরাত্মা, অতি শীঘ্র কুণ্ড থেকে বাইরে বেরিয়ে এসো।” এইকথার প্রত্যুত্তরে ভীম বর্বরীককে যা বলেন, তার সবটুকু উল্লেখ করে আপনাদের ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটাব না, কেবল অংশবিশেষ উল্লেখ করলেই এই অংশটির লেখক ভীমচরিত্রকে কিভাবে অঙ্কন করেছেন, তা যথেষ্ট হবে- “তোর কা কা রবে আমার কর্ণদ্বয় বধির হইয়া গেল, তুই যথেচ্ছ বিলাপই কর আর শুকাইয়াই মর, আমি কিন্তু এখানে জলপান করিবই।” যদি এই অংশকে প্রক্ষিপ্ত ধরে না নিই এবং মহাভারত ও স্কন্দপুরাণ একই বেদব্যাসের হাতে রচিত হয়েছে ধরে নিই, তবে এ কথা বলতেই হয়, মহাভারতে ভীমচরিত্রের মধ্যে যে রাক্ষসস্বভাব পরিলক্ষিত হয়, স্কন্দপুরাণে এসে তা পূর্ণতা পেয়েছে।”
বর্বরীক ভীমকে তাঁর এই কাজের জন্য আক্রমণ করলে দু'জনের মধ্যে ঘোর মল্লযুদ্ধ আরম্ভ হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বর্বরীক ভীমকে পরাজিত করে তাঁকে মহীসাগরে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলে স্বয়ং মহেশ্বর তাঁকে নিষেধ করেন এবং ভীমের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে তাঁকে অবগত করান। বর্বরীক তাঁর পিতামহের প্রতি এতক্ষণ তাঁর ব্যবহারের কথা স্মরণ করে মহীসাগরসঙ্গমে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে চাইলে ভীম তাকে বাধা দেন এবং কোনোক্রমে তাকে শান্ত করে অপরাপর পাণ্ডবদের কাছে নিয়ে যান।
ভীম-বর্বরীকের এই ঘটনা পড়লে ভাসের 'মধ্যমব্যায়োগ' নাটকের কথা মনে পড়ে যায়। তবে স্কন্দপুরাণের এই অংশ থেকে 'মধ্যমব্যায়োগ' অনুপ্রাণিত নাকি 'মধ্যমব্যায়োগ' থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে এই অংশটির অবতারণা, তা বেদ-পুরাণ বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন।
বর্বরীককে সঙ্গে করে ভীম পাণ্ডবদের কাছে পৌঁছে দেখলেন যুধিষ্ঠির দেবী চণ্ডিকার আরাধনা করছেন। ভীম যুধিষ্ঠিরকে তাঁর এই 'বালসুলভ' কাজের জন্য ভর্ৎসনা করতে গিয়ে দেবীর কোপে অন্ধ হয়ে যান ও পরে তাঁর স্তব করে পুনরায় দৃষ্টি ফিরে পান, কিন্তু এসব আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়।
ক্রমে বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাস সমাপ্ত করে কুরু-পাণ্ডবরা কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে যুদ্ধার্থে সমবেত হলে উভয়পক্ষীয় প্রধান প্রধান রথী-মহারথীরা পরস্পরের সামর্থ্য জানার জন্য তাঁরা একাকী যুদ্ধ করে কত দিনে শত্রুসৈন্য বিনষ্ট করতে পারেন তা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।
চরমুখে কৌরবপক্ষীয় বীরদের কথা শুনে যুধিষ্ঠির তাঁর প্রধান ভরসা অর্জুনকে ‘তিনি কতদিনে সমগ্ৰ কৌরবসেনা ধ্বংস করতে পারেন’ জিজ্ঞেস করলে অর্জুন উত্তর দেন, তিনি ইচ্ছা করলে একদিনেই সমগ্ৰ কৌরবসৈন্য সংহার করতে পারেন।
অর্জুনের এই বক্তব্যে চতুর্দিকে সাধুবাদ উঠলেও বর্বরীক করজোড়ে বিনম্র চিত্তে পাণ্ডবদের সামনে নিবেদন করলেন, তিনি চাইলে এক মুহূর্তেই সকল সৈন্য নাশ করতে পারেন। তাঁর কথায় কৃষ্ণার্জুন সহ সকল পাণ্ডবপক্ষীয় বীর বিষ্ময় প্রকাশ করলে তিনি তূণীর থেকে একটি বাণ গ্ৰহণ করে সেটিকে তাঁর কাছে সযত্নে রক্ষিত বিজয়প্রদত্ত ভস্মে অনুলিপ্ত করে কৌরব-সৈন্যাভিমুখে নিক্ষেপ করলে সেই ভস্ম কেবল কৌরবই নয়, পাণ্ডবসৈন্যদের ওপরেও পতিত হল। ভীষ্মের সমস্ত রোমকূপে, দ্রোণ-কর্ণ-শকুনি-ভগদত্ত-বিরাট-দ্রুপদ-ধৃষ্টদ্যূম্নদের কণ্ঠে, দুর্যোধনের উরুতে, শল্যের বক্ষে, শিখণ্ডীর কোমরে ও কৃষ্ণের পদতলে সেই ভস্ম পতিত হলে তাঁদের সেই সেই অঙ্গ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ল। এরপর বর্বরীক দেবীপ্রদত্ত বাণ নিক্ষেপ করে তাঁদের সেই দুর্বল জায়গাগুলিতে আঘাত করে তাঁদের হত্যা করতে উদ্যত হওয়ামাত্রই কৃষ্ণ তাঁর চক্র নিক্ষেপ করে বর্বরীকের মস্তক ছেদন করলেন। পাণ্ডবশিবিরে হাহাকার উঠল, ঘটোৎকচ পুত্রের মৃতদেহের ওপর লুটিয়ে পড়ে ডুকরে কাঁদতে শুরু করলেন।
এই সময় সিদ্ধাম্বিকা সমেত চোদ্দজন মাতৃকা উপস্থিত হয়ে বর্বরীকের প্রকৃত পরিচয় ও কৃষ্ণের এমন কার্যের ব্যাখ্যা দিলেন। তাঁরা বললেন, “দ্বাপরে ভূ-ভার হরণের জন্য যখন ব্রহ্মা সকল দেব-দৈত্য-দানব-রক্ষ-যক্ষদের মনুষ্যযোনিতে জন্মগ্ৰহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন, তখন সূর্যবর্চ্চা নামে এক গন্ধর্ব বলেন, “আমি থাকতে বাকি দেবতারা পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার কষ্ট করবেন কেন? আমি একাকীই ভূ-ভার হরণের পক্ষে যথেষ্ট।” সূর্যবর্চ্চার এহেন গর্বোদ্ধত কথা শুনে ব্রহ্মা তাঁকে অভিশাপ দেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বেই কৃষ্ণের হাতে তার মৃত্যু হবে। বর্বরীক এই সূর্যবর্চ্চারই মানবরূপী অবতার ছিলেন। ব্রহ্মার কথার সত্যতা বজায় রাখতেই কৃষ্ণ বর্বরীককে হত্যা করেছেন। তাই তাঁকে দোষারোপ করা সমবেত রাজগণের উচিৎ নয়।”
কৃষ্ণ, চণ্ডিকা ও সেই চোদ্দজন মাতৃকার কাছে বর্বরীকের মাথাটিকে অমর করে রাখার আবেদন জানালে চণ্ডিকা অমৃতবারি সিঞ্চন করে সেটিকে অজর, অমর ও অক্ষয় করে রাখলেন। বর্বরীকের মাথাটিকে স্থাপন করা হল কুরুক্ষেত্রের সর্বোচ্চ প্রান্তরে, যেখান থেকে সে সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রের ওপর নজর রাখতে পারবে। কৃষ্ণের আশীর্বাদে বর্বরীক যাবতীয় শিশুরোগের উপশমকারী দেবতা রূপে পরিগণিত হলেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধান্তে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের স্তব করতে লাগলে ভীম ক্রুদ্ধ হন। তিনি বলেন, “অর্জুন, ধৃষ্টদ্যূম্ন, সাত্যকি এমনকি স্বয়ং ভীমের স্তব না করে যুধিষ্ঠির একজন সামান্য সারথির স্তব করছেন কোন বুদ্ধিতে?” অর্জুন তাঁকে শান্ত করে বলেন, কৃষ্ণের প্রকৃত স্বরূপ না জেনে তাঁর সম্পর্কে এমন মন্তব্য করা ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে পাণ্ডবপক্ষের কোনো যোদ্ধাই নন, তিনি দেখেছেন এক আশ্চর্য পুরুষ পাণ্ডবপক্ষীয় সৈন্যদের আগে আগে থেকে কৌরবসৈন্য নাশ করেছেন। অর্জুনের এই কথা শুনে ভীম অর্জুনের মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে অর্জুন তাঁকে বর্বরীকের কাছে নিয়ে যান। বর্বরীক বলেন, “বামদিকে পঞ্চমুখ ও দক্ষিণদিকে একমুখবিশিষ্ট একজনমাত্র পুরুষকেই আমি শত্রুগণসহ যুদ্ধ করতে দেখেছি। তাঁর বামদিকে শূলাদি আয়ুধ পরিপূর্ণ দশটি হাত ও দক্ষিণে চক্রাদি আয়ুধ পরিপূর্ণ চারটি হাত বিদ্যমান। তাঁর বামদিকে জটাজাল ও ভস্মানুলিপ্ত এবং দক্ষিণে স্বর্ণকিরীট ও চন্দনানুলিপ্ত। তিনি বামাঙ্গে চন্দ্রকলাধারী ও দক্ষিণে কৌস্তুভমণিশোভিত।” বর্বরীকের এই কথায় ভীম লজ্জিত হন ও ব্রীড়াবনত চিত্তে কৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়ে তাঁর স্তব করতে থাকেন।
এতক্ষণ আমরা আলোচনা করলাম লোককথায় ও শাস্ত্রে বর্বরীকের উল্লেখ এবং তাঁর উপাখ্যানের ক্রমবিবর্তন ও তুল্যতা বিচার নিয়ে। দুই উপাখ্যানের মধ্যে সমতা ও পার্থক্য আপনাদের সামনেই দৃশ্যমান। ভবিষ্যতে মহাভারতের সঙ্গে স্কন্দপুরাণের এই অংশটির তুলনা করে এক ছিন্ন চিত্রকে পরিপূর্ণতা দানের চেষ্টা করব। কিন্তু তার সম্ভাবনা বর্তমানে কালের গর্ভে নিমজ্জিত, পরে সুযোগ পেলে এ বিষয়ে প্রবন্ধ অবশ্যই রচনা করব।
#Ekadashi24
https://www.facebook.com/Ekadashi24/
https://ekadashi24.blogspot.com/
[ পঞ্চম বৈদিক গ্ৰুপে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এই প্রবন্ধটি ]( সংগ্রহীত)