বৈদিক সংস্কৃতিতে দশবিধ সংস্কারের কথা উল্লেখ রয়েছে। তার মধ্যে সপ্তম সংস্কার হচ্ছে চূড়াকরণ।চূড়াকরণসংস্কারে মাথায় শিখা রাখতে হয়।কেননা চূড়াকরণ বা শিখা রাখার পরেই উপনয়ণ বা দীক্ষা লাভ করা হয়।শিখা রেখে গুরুদেব তাঁর শিষ্যকে সংস্কারের পাত্র করে তোলেন।
এখন শিখা ধারণের আবশ্যকতা নিয়ে আলোচনা করব।
সদোপবীতিনা ভাব্যং সদা বদ্ধ শিখেন চ।বিশিখো বি উপবিতশ্চ যৎ করোতি ন তৎ কৃতম্।।(কাত্যায়ন স্মৃতি ১/৪)।
অনুবাদ-সবসময় উপবীতি (উপবীতি অর্থ পৈতা ধারণ অথবা বাম কাঁধে পৈতার মতো উত্তরীয় বস্ত্র ধারণ), ও শিখা বন্ধন করে থাকবে।কারণ শিখা বিহীন কোন ধর্ম কাজ সফল হয় না।
ঋষি ব্যাসদেব বলছেন-
বিনা যৎ শিখয়া কর্ম বিনা যজ্ঞোপবীতম্।
রাক্ষসং তদ্ধি বিজ্ঞেয়ং সমস্তা নিষ্ফলা ক্রিয়াঃ।।
অনুবাদ-সবসময় উপবীত (অথবা উত্তরীয় বস্ত্র) ও শিখা ধারণ করে থাকবে।অন্যথা সমস্ত কর্ম রাক্ষস কর্মে পরিণত হবে ও নিষ্ফল হয়ে যাবে।
মানব জাতির পিতা মনু বলছেন-
স্নানে দানে জপে হোমে সন্ধ্যায়াং দেবতার্চনে।শিখাগ্রন্থিং সদা কুর্যাৎ ইত্যেন মনুঃ অব্রবীৎ।।
অনুবাদ-স্নান,দান,জপ,হোম,সন্ধ্যা বন্দনা,এবং পূজার্চনাতে সব সময় শিখা বন্ধন করে রাখবে। এটা মনুর নির্দেশ।
শিখা ধারণে আরো লাভ আছে।
যথা-
দীর্ঘায়ুত্বায় বলায় বর্চসে শিখায়ৈ বষট্।
অনুবাদ-শিখা ধারণ করলে দীর্ঘায়ু, তেজ,বল ও উজ্জ্বল্যতা বৃদ্ধি পায়।
কেউ যদি শিখা ছেদন করে তার অবস্থা কিহয়?
লঘু হারীত নামক শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে-
শিখাং ছিন্দন্তি যে মোহাদ্ দ্বেষাদ্ অজ্ঞানতোহপি বা।
তপ্তকৃচ্ছেন শুধ্যন্তি ত্রয়ো বর্ণা দ্বিজাতয়ঃ।।
অনুবাদ-যদি কেউ মোহ,দ্বেষ,অথবা অজ্ঞতার ফলে শিখা কেটে ফেলে, তারা তপ্তকৃচ্ছ নামক ব্রত করলে তারপর ঐ পাপ থেকে মুক্তি লাভ করবে।
আমাদের মধ্যে এই দৃঢ় মনোভাব থাকা উচিৎ যে,প্রয়োজনে শরীর থেকে মাথা কাটা যাবে কিন্তু মাথা থেকে কখনো শিখা কাটতে দেব না।মরতে হলে মাথায় পবিত্র শিখা নিয়ে মৃত্যু বরণ করব।
ভবিষ্য পুরাণে (২/২১/৭২)বলা হয়েছে-
সংস্কৃতা শুদ্রবর্ণেন ব্রহ্মবর্ণমুপাগতা। শিখা সূত্রং সমাধায় পঠিত্বা বেদমুত্তমম্।।
অনুবাদ-শিখা এবং যজ্ঞসূত্র ধারণ করে শুদ্ররাও ব্রাহ্মণে পরিণত হয়ে উত্তমরূপে বেদ পাঠ করতে পারে।
তাহলে এখানে দেখা যাচ্ছে শুদ্রও শিখা ধারণ করতে পারে।
ভবিষ্য পুরাণে (১/২২/২৫)বৈদিক ধর্মের বিরোধিতা কারীদের কতগুলো বৈশিষ্ঠ্য বলা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে "শিখাহীনঃ"অর্থাৎ-মাথায়শিখা থাকবেনা।কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে,অধিকাংশ সনাতনীরাই শিখা ধারণ করেনা।যখন তারা মাতা পিতার শ্রাদ্ধ করে তখন মন্ত্র পাঠ করে-
ব্রহ্মবাণী সহস্রাণী শিববাণী শতেন চ।বিষ্ণুর্নাম সহস্রেণ শিখা বন্ধং করোম্যহম্।।
অনুবাদ-ব্রহ্মার নাম সহস্রবার উল্লেখ করে,শিবের নাম শতবার উল্লেখ করে ও বিষ্ণুর নাম সহস্রবার উল্লেখ করে আমি আমার শিখা বন্ধন করছি।যদিও তাদের মাথায় শিখা থাকেনা,তবুও তারা "শিখা বন্ধন করছি "এই মন্ত্র বলে ব্রহ্মা,বিষ্ণু ও শিবের নামে এক বিরাট মিথ্যাকথা বলে।অর্থাৎ মিথ্যা কথাদিয়ে শ্রাদ্ধ আরম্ভ করে।কখনো কখনো কতিপয় কৃষ্ণভক্ত পরিস্থিতির শিকার হয়ে শিখা রাখতে পারেননা। তাঁদের প্রতি অনুরোধ যদি পরিস্থিতি বর্তমানে আপনার অনুকূলে থাকে,তবে তারাতারি শিখা ধারণ করুন।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে-
তিলকং তুলসীমালাং শিখা কৌপিন বহির্বাস।
হরের্নাম সদামুখে বৈষ্ণব পঞ্চ লক্ষণম্।।
অনুবাদ- তিলক,তুলসীমালা,শিখা,কৌপিন বহির্বাস, ও মুখে হরিনাম,এই ৫টি বৈষ্ণবের লক্ষণ।
শিখার কিছু নিয়মাবলী-
শ্মশানে গেলে,টয়লেটে গেলে,রাতে ঘুমানোর সময় শিখা খোলা থাকবে।আর অন্য সময় শিখা বদ্ধ থাকবে। তাই সনাতন সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ এই শিখা ধারণ করে দ্বিজত্ব লাভকরা আমাদের কর্তব্য।নিজে শিখা ধারণ করুন ও অপরকে শিখা ধারণ করতে উৎসাহিত করুন।