|| বিষ্ণুপুরের মল্লরাজবংশের কুলদেবতা শ্রীশ্রী মদনমোহনের বর্গী আক্রমণ রুখে দেওয়ার কাহিনী ||
তখন সতেরশো খ্রিস্টীয় শতকের গোড়ার দিক। মুঘল সাম্রাজ্য পতনের দিকে,আর তার ক্ষতকে আরো বাড়িয়ে তুলছে মারাঠা আক্রমণ। সে আক্রমণ থেকে এই বাংলাও রেহায় পাইনি। মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহও সে আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ। এই দক্ষিণবঙ্গে শীতের প্রারম্ভে পাড়ি জমাত মারাঠা বর্গি বাহিনী। লুটপাট করে তার আবার ফিরে যেত বর্ষায়। এমনি একবার বাঁকুড়ার উপকণ্ঠে হুগলির গড়মান্দারনে ঘাঁটি গাড়লো দুর্ধর্ষ বর্গীরা।
সময়টা ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দ , তাদের চোখ মল্ল রাজধানী বিষ্ণুপুরের মন্দির ও তার ধনসম্পদ লুঠ করাতে। বিষ্ণুপুর মল্ল সিংহাসনে তখন বিরাজমান মল্লরাজ রঘুনাথ মল্লের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মল্লরাজ গোপাল সিংহ মল্ল ( ১৭৩০ - ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দ )। তিনি ছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব , সমস্ত রাজ্যপাট শ্রীশ্রী মদনমোহন এর পায়ে সঁপে দিনরাত নিমগ্ন থাকতেন হরিনামগানে। সুকণ্ঠি মহারাজা গোপাল সিংহ তাঁর নিজের পাশাপাশি প্রত্যেক প্রজাকে সকাল ও সন্ধ্যা নামগান করতে বাধ্য করেছিলেন। যা পরবর্তীকালে প্রজাদের কাছে 'গোপালের বেগার খাটা'য় পরিণত হয়। এই কথাটি এখনো বিষ্ণুপুরের মানুষ প্রবাদবাক্য রূপে ব্যাবহার করে।
যাইহোক বর্গী আক্রমণ এর সম্ভাবনার খবর গুপ্তচর মারফৎ এল মল্লরাজ গোপালে সিংহের কানে।
শত্রুকে প্রতিহত করতে বৈষ্ণব রাজা রণসজ্জা তো দূরের কথা, রাজ্যে ঢেরা করলেন দিন রাত তার রাজ্যে চলবে শুধু নামগান আর মদনমোহন স্মরণ। রাজার দৃঢ় বিশ্বাস মদনমোহন ঠিক বাঁচাবেন তার রাজ্য এবং প্রজাকে বর্গীর আক্রমণ এর হাত থেকে। সেনাপতি মহারাজার সামনে রাজার কথা অমান্য না করলেও সাজিয়ে রাখলেন তার কামান বাহিনী। যতই হোক বেঘোরে তো আর প্রাণ দেওয়া যায় না।
বর্গী বাহিনী তখন বিষ্ণুপুরের উপকণ্ঠে রায়বাঘিনী, কোতলপুর, জয়পুর ধংস করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে আসছে বিষ্ণুপুরের দিকে। বর্গী বাহিনীর শক্তি আরো বাড়ল ভাস্কর পণ্ডিত এর বাহিনী তাতে যোগ দেওয়ায়।কিন্তু বর্গী রা লুঠ করতে পারেনি বিষ্ণুপুর।
কি হয়েছিল?
এক কামানের শকট বাহক এসে খবর দিল সাদা ঘোড়ায় চেপে নীল পাঞ্জাবি পরিহিত এক কিশোর কামানের আক্রমণে প্রতিহত করেছে বর্গী বাহিনীকে। শিলাবতির ঘাটে পড়ে আছে হাজার হাজার বর্গী সেনার মুণ্ডু।
কিশোরটির বগলে ছিল বিশাল কামান দলমাদল। এই ঘটনা দেখে সেনাটি সেখানে তার জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফিরতেই সে এসেছে রাজাকে খবর দিতে। এমতাবস্থায় রাজা গোপাল সিংহ সেনাটিকে মিথ্যেবাদী ভেবে শাস্তি বিধান করতে যাবে ঠিক সেই সময় রাজার গোয়ালা এসে জানায় যে , আজ সে রাজার জন্য দই আনতে পারেনি, কারন একটি নীল পাঞ্জাবি পরা ছেলে এসে তাকে বলে সে রাজকুমার, বর্গীদের পরাজিত করে বড় ক্লান্ত হয়ে গেছে । তার কাছে কিছু খেতে চাইলো। রাজগোয়ালা তাকে রাজকুমার ভেবে তার কাছে থাকা দই খেতে দেয়।
এসব শুনে রাজা গোপাল সিংহদেব ছুটে গেলেন তার প্রাণের দেবতার শ্রীশ্রী মদনমোহন মন্দিরে। দেখলেন সেদিন মদনমোহন তার স্বর্ণ সিংহাসনে পরিধান করে আছেন নীল পোষাক, তার ঠোটের কোণে তখনও লেগে আছে দই এর চিহ্ন। লুটিয়ে পড়লেন রাজা গোপাল সিংহ জগৎ অধিশ্বরের সামনে ।
সেদিন বিষ্ণুপুরের প্রতি ঘরের থেকে বেজে উঠেছিল শঙ্খধ্বনি আর উঠেছিল সমবেত নামগান।
লেখক ©বুদ্ধদেব।
ছবি: হ্যালি গোস্বামী
#হরেকৃষ্ণ_সমাচার
Tags:
other