আজ শ্রীশ্রী কূর্মদেবের আবির্ভাব দিবস। শ্রীহরি বিষ্ণুর দশ অবতারের দ্বিতীয় অবতারে বিষ্ণুর কূর্ম বা কচ্ছপের রূপ ধারণ এবং সমুদ্রতলে অধিষ্ঠানের শুভলগ্ন আজ এই জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথি। কূর্ম অবতারে বিষ্ণু কচ্ছপের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ হন। কূর্ম অবতারে বিষ্ণু ক্ষীরোদসাগরে মন্থনের সময় মন্দার পর্বতকে নিজের পিঠে ধারণ করেন। এভাবে বিষ্ণু মন্দার পর্বত ও বাসুকী নাগের সাহায্যে সমুদ্র মন্থন সংঘটিত করেন। বিষ্ণুর বিবাহের ঘটনার সঙ্গেও এই কূর্মরূপ ধারণের সম্পর্ক আছে। একদা ঋষি দূর্বাসা দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে গমন করেন। দেবরাজ ইন্দ্র ঋষিকে দেখে পাদ্যঅর্ঘ্য দিয়ে সেবা করলেন এবং আসন দিলেন। ঋষি দূর্বাসা দেবরাজের সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে এক পারিজাত ফুলের মালা স্বর্গরাজ ইন্দ্রের গলায় দিলেন। দেবরাজের সাথে কথোপকথন শেষ করে ঋষি দূর্বাসা কৈলাস শিখরে মহাদেবকে দর্শনের জন্য গমন করেন। এইদিকে দেবরাজ ইন্দ্র তাহার গলার পারিজাত ফুলের মালাটি হেলাফেলার সঙ্গে জড়িয়ে দেন বাহন হাতিটির শুঁড়ে। কিন্তু সেই মালার সুগন্ধে মৌমাছি এসে যখন শুঁড়ে বসল, হাতি তখন তা নিক্ষেপ করল মাটিতে। ঋষি দূর্বাসা কৈলাস থেকে আগমন কালে পথে সেই পারিজাত ফুলের মালাটি দেখতে পায়। ঋষি দূর্বাসা খুবই ক্রোধান্বিত ঋষি, তিনি মহাদেবের অংশ। ঋষি ধ্যান করে দেখেন ইন্দ্র মালাটি হাতিকে দেন এবং হাতি মালাটি ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তাহার দেওয়া মালা স্বর্গের ভরপুর সম্পত্তির অহঙ্কার করে তাচ্ছিল্য করায় তিনি অপমানিত বোধ করেন। ঋষি দূর্বাসা তাই অভিশাপ দেন ইন্দ্রকে -- দেবরাজ হিসেবে এতো গর্ব, আমাকে অসম্মান করলি, দেবতাদের সে গর্ব বিনাশ হবে। দেবতারা শ্রীহীন হয়ে যাবেন ! ধনদেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে সমস্ত ঐশ্বর্য তলিয়ে যাবে সমুদ্রে ! শ্রীভ্রষ্ট হওয়ার অভিশাপ দিয়ে তিনি চলে যান। ফলে শ্রী দেবী লক্ষ্মী বিলুপ্ত হলো। এভাবে ঋষি দূর্বাসার শাপে বিষ্ণু তাঁর স্ত্রীকে হারান ! স্বর্গ রাজ্যে অরাজগতা দেখা দিল। লক্ষ্মী অন্তর্হিত হওয়ায় দেবতাদের শক্তি দিন দিন হ্রাস পায় যার পরিণামে দেবগণ দিন দিন বলহীন হতে থাকেন। এইজন্য দেবতারা ত্রিদেব মানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের শরণাগত হন। স্বর্গরাজ্য এবং তারা যা কিছু পেয়েছিল এবং উপভোগ করেছিল তা পুনরায় ফিরে পেতে দেবতারা ত্রিদেবের কাছে পরামর্শ প্রার্থনা করেন। বিষ্ণু পরামর্শ দিয়েছিলেন যে তাদের গৌরব ফিরে পেতে তাদের অমরত্বের অমৃত পান করতে হবে। এখন অমরত্বের অমৃত প্রাপ্তির জন্য তাদের ক্ষীরোদসাগর মন্থন করা দরকার। এত বড় একটি মন্থন কার্যে মন্থন-দণ্ড হিসাবে মন্দার পর্বত এবং দড়ি হিসাবে বাসুকী নাগকে প্রয়োজন। কিন্তু এই দুরূহ কাজ শুধুমাত্র দেবতাদের করা কষ্টসাধ্য তাই ভগবান শিবের পরামর্শ অসুরদেরও যেন সমুদ্র মন্থনে আহবান করা হয়। ব্রহ্মাও দেবতাদের অমৃতপ্রাপ্তির জন্য অসুরদের সাহায্যে সমুদ্রমন্থনের পরামর্শ দেন। দেবগণ নিজেরাই মন্থন করার পক্ষে তেমন শক্তিশালী ছিলেন না এবং এই দুরূহ কাজে অসুরদের সাহায্য নিতে তাদের সাথে শান্তি ঘোষণা করেছিলেন। অসুরেরা এই শর্তে রাজী হয় যে সমুদ্র মন্থন থেকে যা প্রাপ্ত হবে তার অর্ধেক অসুরদের দিতে হবে। অমৃতের সন্ধানে দেবতারা ও অসুররা সমুদ্র মন্থনের জন্য ক্ষীরোদসাগরে একত্রিত হয়েছিল। অতঃপর দেবতারা অসুরদের সাহায্য নিয়ে মন্দার পর্বতকে মন্থন-দণ্ড এবং বাসুকী নাগকে দড়ি করে সমুদ্র মন্থন করা শুরু করিবার পূর্বে বুদ্ধিমান ইন্দ্র বলিলেন দেবতারা বাসুকী নাগের মাথার দিকে ধরিবে। আবার অসুররা বিজয়ী, কাজেই তাহারা লেজে হাত দিতে নারাজ। অহঙ্কারে অসুরদের পতনের আরম্ভ বুঝিয়া ইন্দ্র অসুরদের দাবি মানিয়া দেবতাদের লইয়া বাসুকী নাগের লেজ ধরিতে গেলেন। ক্ষীরোদসাগরে মন্দার পর্বতকে বাসুকী নাগ দ্বারা বেষ্টিত করে দেবতা ও অসুররা এটিকে দুপাশ থেকে টানতে শুরু করে। কিন্তু মন্থনকালে মন্দার পর্বত ক্ষীরোদসাগরে ডুবতে শুরু করে, কারন তাকে ক্ষীরোদসাগরের জলের মধ্যে ধরে রাখার জন্য কোনও ভিত্তি ছিল না। অতঃপর বিষ্ণু কূর্ম বা কচ্ছপের রূপ ধারণ করে ক্ষীরোদসাগরে গিয়ে বসেন এবং মন্দার পর্বতকে ধারণ করে থাকেন নিজের পিঠে। সমুদ্র মন্থন শুরু হয়। মন্থন শুরু হওয়ার সাথে সাথে সমুদ্রের গভীর থেকে বিশাল ঢেউ দিয়ে ঘুরেফিরে হলাহল বা কালকূট নামে এক বিষ উঠে আসল। যার ফলে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের বায়ু বিষাক্ত হয়ে গেল। দেবগন এবং অসুরগনের ভিতরেও এই বিষক্রিয়ার প্রভাব দেখা গেল। অনেক দেবতা আর অসুর সেই স্থানেই মুর্ছা গেল। যখন সেই বিষ ব্রহ্মার কাছে গেল, ব্রহ্মাও সেই বিষকে গতি প্রদান করতে অসমর্থ হল। তারপর বৈকুন্ঠপতি বিষ্ণুর কাছে গেল, বিষ্ণুও অপারগতা প্রকাশ করল। শেষ পর্যন্ত শিব সমস্ত সংসারের মঙ্গলের জন্য এই হলাহল বিষ পান করল। সমুদ্রগর্ভ থেকে উঠে আসা হলাহল পান করে শিব অচৈতন্য হয়ে পড়লেন। সেই সময় মা পার্বতী, তারা মায়ের রূপে সেখানে আর্বিভূতা হয়ে শিবকে আপন স্তনের দুগ্ধ পান করালেন, মুহূর্তে ফিরে আসলো শিবের জ্ঞান। শিব সেই হলাহল বা কালকূট নামক বিষকে কন্ঠে ধারণ করে নীলকন্ঠ হলেন। সমুদ্র মন্থন অব্যাহত ছিল। পর পর মন্থিত হলো সুরভী নাম্নী এক কামধেনু, ঐরাবত নামক এক শ্বেতহস্তী, উচ্চৈঃশ্রবা নামক অশ্ব। বিষ্ণুর পরামর্শে সুরভী নাম্নী কামধেনুটিকে যাজ্ঞিক ঋষিগণকে এবং হস্তী ও অশ্ব এই দুটি ইন্দ্রকে প্রদান করা হল। সমুদ্র মন্থনে তারপর চারিদিক আলো করিয়া কৌস্তুভ নামক একটা বড় মণি উঠিলে বিষ্ণু তাহা নিজের গলায় ধারণ করিলেন। মন্থনকালে তারপর সমুদ্র থেকে সৃষ্টির যাবতীয় ঐশ্বর্য-সহ দেবী লক্ষ্মী উত্থিতা হন এবং বিষ্ণুকে স্বামীরূপে বরণ করেন। লক্ষ্মী প্রাপ্ত হয়ে স্বর্গে পুনরায় শ্রী ফিরে আসে, দেবতাদের শক্তি পুনরায় ফিরে পায়। মন্থনকালে একসময় স্নিগ্ধ ও সুগন্ধি বাতাস বহিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে এক স্নিগ্ধ জ্যোতিতে দিবালোক ম্লান হইয়া গেল। এক সুবর্ণ কলস হাতে লইয়া এক জোতির্ময় পুরুষ উঠিয়া আসিলেন। দেবতারা ইঁহার নাম রাখিলেন ধন্বন্তরি। অমৃত সমুদ্র মন্থনে মন্থিত হল। ধন্বত্বরি উঠিয়া আসিবামাত্র অসুরগণ অমৃতের লোভে উন্মত্ত হইয়া কলসীটি কাড়িয়া লইল। দেবতারা ক্রুদ্ধ হইয়া অসুরদিগকে আক্রমণ করিলেন। কিন্তু বিষ্ণুর ইঙ্গিতে তাঁহারা নিরস্ত্র হইলেন। বিষ্ণু মনে মনে চিন্তা করেন অমৃত যদি অসুরগণ ভক্ষণ করেন তাহলে এই পৃথিবী ধ্বংস করে দেবে, আসুরিক প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পাবে। দেবতা, মুনি, ঋষি, নারীদের উপর অত্যাচার হবে। তা নিবারণ করার জন্য বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারণ করলেন অসুরদের প্রতারিত করে এবং অমৃতটি উদ্ধার করেন। বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হয়েছিলেন এক অপরূপা নারী রূপে, তার রূপের ছটায় সমস্ত দেবতা অসুর সহ যে দেবতারাও মুগ্ধ হয়েছিলেন এইরূপ দিয়েই। অসুরদের বিভ্রান্ত করে তিনি এই অমৃতের ওপর সম্পূর্ণ অধিকার লাভ করিয়ে দিয়েছিলেন দেবতাদের। রাহু নামে এক অসুর বড় চতুর। সে দেবতাদের ছদ্মবেশ নিয়ে অমৃত পান করেছিল। সূর্যদেব ও চন্দ্রদেব এটি লক্ষ্য করিয়া বিষ্ণুকে ইঙ্গিতে জানাইলেন। বিষ্ণু তৎক্ষণাৎ সুদর্শনচক্রে রাহুর মাথা কাটিয়া ফেলিলেন। কিন্তু সে ততক্ষণে অমৃত চট্ করিয়া খানিকটা গিলিয়া ফেলিয়াছে। কাজেই তার মাথাও বাঁচিল, স্কন্ধও বাঁচিল। এইরূপে অসুর দ্বিধাবিভক্ত হইলেও অমর হইয়া গেল। এরাই রাহু এবং কেতু। প্রতিবার সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণের সময় গ্রাস করে সূর্য ও চন্দ্রের প্রতি প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করে। দেবতাদের দিতে দিতে কলসের অমৃত নিঃশেষ হইয়া গেল। মোহিনী দেবী সহসা তাহা লক্ষ্য করিয়া চমকিয়া উঠিয়া এমন এক করুণ নিরুপায় দৃষ্টিতে অসুরদিগের দিকে চাহিলেন যে অসুরগণ অমৃতের কথা ভুলিয়া গেল। দেবী প্রসন্না, বরাভয়করা মাতৃমূর্তি দেবতাদের নিকট প্রকাশ করিয়া আকাশে মিলাইয়া গেল। অসুরগণের তখন চমক ভাঙ্গিল। অসংযমের ফল হাতে হাত পাইয়া লজ্জায় তাহারা কেহ কাহারও মুখপানে চাহিতে পারিল না। দেবগণ উচ্চৈঃস্বরে মোহিনীরূপিণী শ্রীহরি বিষ্ণুর মায়াশক্তির জয় ঘোষনা করিলেন। এভাবে বিষ্ণু সৃষ্টিকে রক্ষা করেছিলেন। শাস্ত্রে বিষ্ণুর কূর্ম অবতারের অপরিসীম মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। সমুদ্র মন্থন কালে যখন মন্দার পর্বত সমুদ্রে ডুবতে লাগল তখন কূর্মের রূপ ধরে ভগবান বিষ্ণু পর্বতের ভার বহন করেছিলেন। এই কঠিন কর্মের সাথে শনিদেবের সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। কূর্ম অবতারের বন্দনায় শনিগ্রহের শুভ ফল প্রাপ্ত হয়। মিথ্যা বলা যাবে না, এই মন্ত্রে আজ বিষ্ণুর আরাধনায় পূর্ণ হবে মনের সব বাসনা ! বলা হয়, যাঁরা এই দিন সংযম এবং উপবাস পালন করে ভগবানের আরাধনা করেন, তাঁদের জীবন সর্বদা সুখে স্থির থাকে, মনের সব বাসনা পূর্ণ হয়। বিপুলতরা ক্ষিতি বা পৃথিবী যাঁর পৃষ্ঠে স্থির হয়ে আছে, সেই ধরণী ধারণ করার ভারে যাঁর পিঠে কড়া পড়ে গিয়েছে, কূর্মরূপধারী সেই কেশবের জয় হোক ! সমগ্র বিশ্বের পরম কারণ কূর্মরূপধারী ভগবান বিষ্ণুকে প্রণাম। . ভগবান শ্রীহরি বিষ্ণুর প্রণাম মন্ত্র -- নমো ব্রহ্মণ্যদেবার গোব্রাহ্মণ হিতায় চ। জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ॥ --- ব্রহ্মণ্যদেবকে নমস্কার। গো-ব্রাহ্মণের হিতকারী এবং জগতের মঙ্গলকারী কৃষ্ণকে-গোবিন্দকে নমস্কার। . (সংগৃহীত) #Ekadashi24
https://www.facebook.com/Ekadashi24/
https://ekadashi24.blogspot.com/