একাদশী পালনের দিন ৯ই ডিসেম্বর ২০২৩
একাদশী পারণের দিন ১০ ই ডিসেম্বর ২০২৩
একাদশী পারণের : ১) ভারতীয় সময় (পশ্চিমবঙ্গে) সকাল ৬:১৪ থেকে ৭:১৫ মধ্যে।
২) বাংলাদেশ সময় সকাল ৬:৩৮ থেকে ৭:৪৫ মধ্যে।
উৎপন্না একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
অর্জুন বললেন-হে দেব! অগ্রহায়ণের পুণ্যপ্রদায়ী কৃষ্ণপক্ষের একাদশীকে কেন ‘উৎপন্না’ বলা হয় এবং কি জন্যই বা এই একাদশী পরম পবিত্র ও দেবতাদেরও প্রিয়, তা জানতে ইচ্ছা করি। আপনি কৃপা করে আমাকে তা বলুন।
শ্রীভগবান বললেন- হে পৃথাপুত্র! পূর্বে সত্যযুগে ‘মুর’ নামে এক দানব ছিল। অদ্ভুত আকৃতিবিশিষ্ট সেই দানবের স্বভাব ছিল অত্যন্ত কোপন। সে দেবতাদেরও ভীতিপ্রদ ছিল।
যুদ্ধে দেবতাদের এমনকি স্বর্গরাজ ইন্দ্রকে পর্যন্ত পরাজিত করে স্বর্গ থেকে বিতারিত করেছিল। এইভাবে দেবতারা পৃথিবীতে বিচরণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
তখন দেবতারা মহাদেবের কাছে গিয়ে নিজেদের সমস্ত দুঃখ সবিস্তারে জানালেন। শুনে মহাদেব বললেন- হে দেবরাজ! যেখানে শরণাগতবৎসল জগন্নাথ, গরুধ্বজ বিরাজ করছেন, তোমরা সেখানে যাও। তিনি আশ্রিতদের পরিত্রাণকারী। তিনি নিশ্চয়ই তোমাদের মঙ্গল বিধান করবেন।
দেবাদিদেবের কথামতো দেবরাজ ইন্দ্র দেবতাদের নিয়ে ক্ষীরসমুদ্রের তীরে গমন করলেন। জলে শায়িত শ্রীবিষ্ণুকে দর্শন করে দেবতারা হাতজোড় করে তাঁর স্তব করতে লাগলেন। স্তুতির মাধ্যমে নিজ নিজ দৈন্য ও দুঃখের কথা তাঁরা ভগবানকে জানালেন।
ইন্দ্রের কথা শুনে ভগবান নারায়ণ বললেন- হে ইন্দ্র! সেই মুর দানব কি রকম, সে কেমন শক্তিশালী, তা আমায় বল। ইন্দ্র বললেন-হে ভগবান! প্রাচীনকালে ব্রহ্ম বংশে তালজঙঘা নামে এক অতি পরাক্রমী অসুর ছিল।
তারই পুত্র সেই ‘মুর’ অত্যন্ত বলশালী, ভীষণ উৎকট ও দেবতাদেরও ভয় উৎপাদনকারী। সে চন্দ্রাবতী নামে এক পুরীতে বাস করে।
স্বর্গ থেকৈ আমাদের বিতাড়িত করে তার স্বজাতি কাউকে রাজা, কাউকে অন্যান্য দিকপালরূপ প্রতিষ্ঠিত করে এখন সে দেবলোক সম্পূর্ণ অধিকার করেছে। তার প্রবল প্রতাপে আজ আমরা পৃথিবীতে বিচরণ করছি।
ইন্দ্রের কথা শুনে ভগবান দেবদ্রোহীদের প্রতি অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। তিনি দেবতাদের সঙ্গে চন্দ্রাবতী পুরীতে গেলেন। সেই দৈত্যরাজ শ্রীনারায়ণকে দর্শন করে পুনঃ পুনঃ গর্জন করতে লাগল।
দেবতা ও অসুরের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধে দেবতারা পরাজিত হয়ে এদিক ওদিক পালিয়ে গেল। তখন যুদ্ধক্ষেত্রে শ্রীনারয়ণকে একা দেখে সেই দানব তাঁকে ‘দাঁড়াও দাঁড়াও’ বলতে লাগল। শ্রীভগবানও ক্রোধে গর্জন করে বললেন- রে দুরাচার দানব আমার বাহুবল দেখ।
এই বলে অসুরপক্ষীয় সমস্ত যোদ্ধাদের দিব্য বাণের আঘাতে নিহত করতে লাগলেন। তখন তারা প্রাণভয়ে নানা দিকে পালাতে লাগল।
সেই সময় নারায়ণ দৈত্য সৈন্যদের মধ্যে সুদর্শন চক্র নিক্ষেপ করলেন। ফলে সমস্ত সৈন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হল। একমাত্র মুর অসুরই জীবিত ছিল। সে অস্ত্রযুদ্ধে নারায়ণকেও পরাজিত করল। তখন নারায়ণ দৈত্যের সাথে বাহুযুদ্ধে লিপ্ত হলেন।
এইভাবে দেবতাদের হিসাবে এক হাজার বছর যুদ্ধ করেও ভগবান তাকে পরাজিত করতে পারলেন না। তখন শ্রীহরি বিশেষ চিন্তান্বিত হয়ে বদরিকা আশ্রমে গমন করলেন। সেখাতে সিংহাবতী নামে একটি গুহা আছে।
এই গুহাটি এক-দ্বার বিশিষ্ট এবং বারোযোজন অর্থাৎ ৮৬ মাইল বিস্তৃত। ভগবান বিষ্ণু সেই গুহার মধ্যে শয়ন করলেন। সেই দৈত্যও তার পিছন পিছন ধাবিত হয়ে গুহার ভিতরে প্রবেশ করল।
সে বিষ্ণুকে নিদ্রিত বুঝতে পারল। অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে গোপনে শুয়ে আছে। এখন আমি তাকে অবশ্যই বধ করব। দানবের এইরকম চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীবিষ্ণুর শরীর থেকে একটি কন্যা উৎপন্ন হল।
এই কন্যাই ‘উৎপন্না’ একাদশী। তিনি রূপবতী, সৌভাগ্যশালিনী, দিব্য অস্ত্র-শস্ত্রধারিনী ও বিষ্ণু তেজসম্ভুতা বলে মহাপরাক্রমশালী ছিলেন। দৈত্যরাজ সেই স্ত্রীরূপিনী দেবীর সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু করল।
কিছুকাল যুদ্ধের পর দেবীর দিব্য তেজে অসুর ভস্মীভূত হয়ে গেল। তারপর বিষ্ণু জেগে উঠে সেই ভস্মীভূত
দানবকে দেখে বিস্মিত হলেন। এক দিব্যকন্যাকে তাঁর পাশে হাত জোর করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন।
বিষ্ণু বললেন- হে মহাপরাক্রান্ত উগ্রমূর্তি! এই মুর দানবকে কে বধ করল? যিনি একে হত্যা করেছে তিনি নিশ্চয়ই প্রশংসনীয় কর্ম করেছে।
সেই কন্যা বললেন- হে প্রভু! আমি আপনার শরীর থেকে উৎপন্ন হয়েছি। আপনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন, তখন এই দানব আপনাকে বধ করতে চেয়েছিল। তা দেখে আমি তাকে বধ করেছি। আপনাদের কৃপাতেই আমি তাকে বধ করতে পেরেছি।
একথা শুনে ভগবান বললেন- আমার পরাশীক্ত তুমি একাদশীতে উৎপন্ন হয়েছ। তাই তোমার নাম হবে একাদশী। আমি এই ত্রিলোকে দেবতা ও ঋষিদের অনেক বর প্রদান করেছি। হে ভদ্রে! তুমিও তোমার মনমতো বর প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে তা প্রদান করব।
একাদশী বললেন- হে দেবেশ! ত্রিভুবনের সর্বত্র আপনার কৃপায় সর্ববিঘ্ননাশিনী ও সর্বদায়িনী রূপে যেন পরম পূজ্য হতে পারি, এ বিধান করুন। আপনার প্রতি ভক্তিবশতঃ যারা শ্রদ্ধাসহকারে আমার ব্রত-উপবাস করবে, তাদের সর্বসিদ্ধি লাভ হবে-এই বর প্রদান করুন।
বিষ্ণু বললেন-হে কল্যাণী! তাই হোক। ‘উৎপন্না’ নামে প্রসিদ্ধ তোমার ব্রত পালনকারীর সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ হবে। তুমি তাদের সকল মনোবাসনা পূর্ণ করবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
তোমাকে আমার শক্তি বলে মনে করি। তাই তোমার ব্রত পালকারী সকলে আমারই পূজা করবে। এর ফলে তারা মুক্তি লাভ করবে। তুমি হরিপ্রিয়া নামে জগতে বিখ্যাত হবে।
তুমি ব্রতপালনকারীর শত্রুবিনাশ, পরমগতি দান এবং সর্বসিদ্ধি প্রদান করতে সমর্থ হবে। ভগবান বিষ্ণু এইভাবে ‘উৎপন্না’ একাদশীকে বরদান করে অন্তর্হিত হলেন।
আরও পড়ুনঃ একাদশী পালনের নিয়মাবলী
সমস্ত ব্রতকারী দিবারাত্রি ভক্তিপরায়ণ হয়ে এই উৎপন্না একাশীর উৎপত্তির কথা শ্রবণ-কীর্তন করলে শ্রীহরির আশীর্বাদ লাভে ধন্য হবে।
একাদশীর পারণ মন্ত্রঃ ---
”অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব॥” (বৃ: না: পু: ২১/২০)
বিবাহিত নারীদের ত্রকাদশী করার শাস্ত্র নিদের্শঃ
(১)
ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদ্রণাঞ্চৈব যোষিতাম্।
মোক্ষদং কূর্ব্বতাং ভক্ত্যা বিষ্ণো:প্রিয়তরং দ্বিজাঃ।।
[ বৃহন্নারদীয় পুরাণ, অধ্যায়-২১ শ্লোক-২ ]
অনুবাদ:
ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য,শুদ্র এবং বিবাহিত স্ত্রীলোক - ইহাদিগের মধ্যে যে কোন ব্যক্তি হউক, ভক্তি পূর্ব্বক একাদশী ব্রত পালন করে মুক্তি লাভ করতে পারে।
(২)
পতিসহিতা যা যোষিৎ করোতি হরিবাসরম্ ।
সুপুত্ৰা স্বামিসুভগা যাতি প্রেত্য হরের্গৃহম॥ ৭৬
যো যচ্ছতি হরেরগ্রে প্রদীপং ভক্তিভাবতঃ।
হরের্দিনে দ্বিজশ্রেষ্ঠ পুণ্যসঙ্গ্যা ন বিদ্যতে ॥৭৭
যাঙ্গনা ভর্ত্তৃসহিতা কুরুতে জাগরং হরেঃ।
হরের্নিকেতনে তিষ্ঠেচ্চিরং পত্যা সহ দ্বিজ ॥৭৮
[ পদ্মপুরাণ, স্বর্গখন্ড, অধ্যায় ৪৪, শ্লোক- ৭৬-৭৮ ]
বঙ্গানুবাদঃ
যে স্ত্রী পতি সহ একাদশীব্রত করে, সে সুপুত্রা স্বামি-সুভাগা হয়, মরণান্তে হরিগৃহ বৈকুন্ঠে যায়। দ্বিজ শ্রেষ্ঠ! একাদশীতে ভক্তিভাবে যে জন হরির অগ্রে প্রদীপ দান করে, তাহার পুণ্যের সংখ্যা নাই অর্থাৎ অগণিত পুণ্য লাভ করে । আর যে স্ত্রী স্বামীর সহিত একাদশীতে রাত্রি জাগরণ করে, সে চিত্রকাল পতি সহ হরির নিকেতনে বাস করে।
(৩)
যা নারী স্বামীসহিতা কুর্য্যাচ্চ হরিবাসরম।
সুপুত্রা ভর্ত্তসুভগা ভবেৎ সা প্রতিজন্মানি।।
[ পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মখন্ড, ৫।১৯ ]
বঙ্গানুবাদঃ
যে নারী স্বামীর সাথে একাদশীব্রত করে, সে জন্মে জন্মে সপুত্রা ও স্বামীসুভগা হয়।
(৪)
যা নারী ভর্ত্তৃসহিতা করোত্যেকাদশীব্রতম্।
সুপ্ৰজা স্বামিসুভগা সা ভবেৎ প্রতিজন্মনি।
স্বামিনা সহ যা নারী কুরুতে জাগরং হরেঃ।
সা তিষ্ঠেদ্বিষ্ণুভবনে চিরং ভর্ত্রা সহ দ্বিজ ।।
[ পদ্মপুরাণ, ত্রিয়াযোগসারঃ অধ্যায়-২২ শ্লোক- ১০৫ ]
বঙ্গানুবাদঃ
যে নারী স্বামীর সাথে একাদশীব্রত করে, সে জন্মে জন্মে সুপুত্রা ও স্বামীসুভগা হয়। আর যে নারী স্বামীর সঙ্গে জাগরানুষ্ঠান করে, সে স্বামীর সাথে সুচিরকাল বৈকুন্ঠধামে অবস্থান করে।
(৫)
দুর্ভাগা যা করোত্যেনাং সা স্ত্রী সৌভাগ্যমাপ্নুয়াৎ।
লোকানাঞ্চৈব সর্ব্বোষাং ভুক্তিমুক্তিপ্রদায়িনী।।
[ পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, ৪৮।৪ ]
বঙ্গানুবাদঃ
কোন দুর্ভাগা #স্ত্রী যদি একাদশী ব্রত আচরণ করেন, তিনি সৌভাগ্য লাভ করেন। এই একাদশী ব্রত সর্বলোকের ভুক্তিমুক্তিপ্রদায়িনী, সর্ব্বপাপহারিণী ও গর্ভবাসনিবারিণী।
(৬)
সপুত্রশ্চ সভাৰ্য্যশ্চ স্বজনৈৰ্ভক্তিসংযুতঃ।
একাদশ্যামুপবসেৎ পক্ষয়োরভয়োরপি ॥
[ বিষ্ণুধর্মোত্তর, হ.ভ.বি., ১২।৪৭ ]
বঙ্গানুবাদঃ
পুত্র, ভার্যা (পত্নী) ও স্বজনবর্গের সহিত ভক্তিযুক্ত হয়ে উভয়পক্ষের একাদশীতে উপবাস কর্তব্য।"
Tags:
একাদশী