তৃতীয় অধ্যায়
শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত অবতারের উৎস
শ্লোক ১
সূত উবাচ
জগৃহে পৌরুষং রূপং ভগবান্মহদাদিভিঃ ।
সম্ভূতং ষোড়শকলমাদৌ লোকসিসৃক্ষয়া ॥ ১ ॥
অনুবাদ: শ্রীল সূত গোস্বামী বললেনঃ সৃষ্টির আদিতে পরমেশ্বর ভগবান প্রথমে তাঁর পুরুষ-অবতারে বিরাট রূপে নিজেকে প্রকাশ করেন এবং মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার এবং পঞ্চতন্মাত্র আদি জড় সৃষ্টির সমস্ত উপাদানগুলি প্রকাশ করেন। এইভাবে জড় জগৎকে সৃষ্টি করার জন্য তিনি প্রথমে ষোলটি তত্ত্ব সৃষ্টি করেন।
শ্লোক ২
যস্যাম্ভসি শয়ানস্য যোগনিদ্রাং বিতন্বতঃ।
নাভিহ্রদাম্বুজাদাসীব্রহ্মা বিশ্বসৃজ্জাং পতিঃ ॥ ২॥
অনুবাদ
পুরুষাবতারের এক অংশ গর্ভোদকে শয়ন করে যোগনিদ্রা বিস্তার করেন। তাঁর নাভি থেকে একটি পদ্ম বিকশিত হয় এবং সেই পদ্ম থেকেই প্রজাপতিদের পতি ব্রহ্মা জন্মগ্রহণ করেন।
শ্লোক ৩
যস্যাবয়বসংস্থানৈঃ কল্পিতো লোকবিস্তরঃ ।
তদ্বৈ ভগবতো রূপং বিশুদ্ধং সত্ত্বমূর্জিতম্ ॥ ৩ ॥
অনুবাদ
সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড পুরুষের বিরাট শরীরে অবস্থিত, কিন্তু তাঁর সৃষ্ট এই জড় উপাদানের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্বন্ধ নেই। তাঁর শরীর পরম উৎকর্ষ সহকারে পরা-প্রকৃতিতে অবস্থিত।
শ্লোক ৪
পশ্যন্ত্যদো রূপমদভ্রচক্ষুষা সহস্রপাদোরুভুজাননাদ্ভূতম্।
সহস্রমূর্ধশ্রবণাক্ষিনাসিকং সহস্রমৌল্যম্বরকুণ্ডলোল্লসৎ ॥৪॥
অনুবাদ
ভক্তরা তাঁদের বিজ্ঞান-চক্ষুর দ্বারা পরম চমৎকার অসংখ্য হস্ত-পদ-মুখ যুক্ত পুরুষের দিব্য রূপ দর্শন করেন। সেই শরীরে অসংখ্য মস্তক, কর্ণ, চক্ষু এবং নাসিকা রয়েছে। সেগুলি অসংখ্য মুকুট, উজ্জ্বল কুণ্ডল এবং মালিকার দ্বারা শোভিত।
শ্লোক ৫
এতন্নানাবতারাণাং নিধানং বীজমব্যয়ম্।
যস্যাংশাংশেন সৃজ্যন্তে দেবতির্যরাদয়ঃ ॥ ৫ ॥
অনুবাদ
এই রূপ (দ্বিতীয় পুরুষাবতার) ব্রহ্মাণ্ডে প্রকাশিত অসংখ্য অবতারদের উৎস এবং অবিনশ্বর বীজ। এই রূপের অংশ এবং কলা থেকে দেবতা, মনুষ্য আদি বিভিন্ন জীবের সৃষ্টি হয়েছে।
শ্লোক ৬
স এব প্রথমং দেবঃ কৌমারং সর্গমাশ্রিতঃ ।
চচার দুশ্চরং ব্রহ্মা ব্রহ্মচর্যমখণ্ডিতম্ ।। ৬॥
অনুবাদ
সৃষ্টির আদিতে প্রথমে ব্রহ্মার চারজন অবিবাহিত পুত্র (চতুঃসন বা কুমারেরা) ছিলেন, যাঁরা ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে পরম সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন।
শ্লোক ৭
দ্বিতীয়ং তু ভবায়াস্য রসাতলগতাং মহীম্।
উদ্ধরিষ্যন্নপাদত্ত যজ্ঞেশঃ সৌকরং বপুঃ ॥৭॥
অনুবাদ
এই পৃথিবী যখন রসাতলে পতিত হয়েছিল, তখন এই বিশ্বের মঙ্গলের জন্য পৃথিবীকে উদ্ধার করতে ইচ্ছুক হয়ে সমস্ত যজ্ঞের পরম ভোক্তা যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণু দ্বিতীয় অবতারে বরাহ রূপ ধারণ করেছিলেন।
শ্লোক ৮
তৃতীয়মৃষিসর্গং বৈ দেবর্ষিত্বমুপেত্য সঃ।
তন্ত্রং সাত্বতমাচষ্ট নৈষ্কর্য্যং কর্মণাং যতঃ ।॥ ৮ ।॥
অনুবাদ
ঋষিকল্পে পরমেশ্বর ভগবান দেবর্ষি নারদরূপে তাঁর তৃতীয় শক্ত্যাবেশ অবতারে আবির্ভূত হন। বেদের যে সমস্ত বর্ণনা ভগবদ্ভক্তি এবং নিষ্কাম কর্ম সম্বন্ধে জীবকে অনুপ্রাণিত করে, তিনি সেগুলি সংকলন করেছিলেন।
শ্লোক ৯
তুর্যে ধর্মকলাসর্গে নরনারায়ণাবৃষী।
ভূত্বাত্মোপশমোপেতমকরোৎ দুশ্চরং তপঃ ॥ ৯ ॥
অনুবাদ
চতুর্থ অবতারে ভগবান ধর্মরাজের পত্নীর গর্ভে নর এবং নারায়ণ নামক যমজ পুত্ররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁরা ইন্দ্রিয়-সংযমের আদর্শ প্রদর্শন করার জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন।
শ্লোক ১০
পঞ্চমঃ কপিলো নাম সিদ্ধেশঃ কালবিপ্লুতম্।
প্রোবাচাসুরয়ে সাংখ্যং তত্ত্বগ্রামবিনির্ণয়ম্ ॥ ১০॥
অনুবাদ
পঞ্চম অবতারে তিনি ঋষিশ্রেষ্ঠ শ্রীকপিল নামে অবতরণ করেন। তিনি আসুরি নামক ব্রাহ্মণকে সৃষ্টির উপাদানসমূহ বিশ্লেষণ করে সাংখ্য দর্শন প্রদান করেন, কেন না কালের প্রভাবে সেই জ্ঞান লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
শ্লোক ১১
ষষ্ঠম্ অত্রেরপত্যত্বং বৃতঃ প্রাপ্তোহনসূয়য়া।
আন্বীক্ষিকীমলকায় প্রহ্লাদাদিভ্য উচিবান্ ॥ ১১ ॥
অনুবাদ
পরম পুরুষের ষষ্ঠ অবতার হচ্ছেন মহর্ষি অত্রির পুত্র ভগবান দত্তাত্রেয়। মাতা অনসূয়ার প্রার্থনায় তিনি তাঁর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি অলক, প্রহ্লাদ এবং অন্য অনেককে পারমার্থিক জ্ঞান দান করেছিলেন।
শ্লোক ১২
ততঃ সপ্তম আকৃত্যাং রুচের্যজ্ঞোহভ্যজায়ত।
স যামাদ্যৈঃ সুরগণৈরপাৎস্বায়ম্ভুবান্তরম্ ॥ ১২ ॥
অনুবাদ
সপ্তম অবতার হচ্ছেন প্রজাপতি রুচি ও তাঁর পত্নী আকৃতির পুত্র যজ্ঞ। স্বায়ম্ভব মন্বন্তরে তিনি এই ব্রহ্মাণ্ড পালন করেছিলেন এবং তাঁর পুত্র যাম আদি দেবতারা তাঁকে সেই কার্যে সাহায্য করেছিলেন।
শ্লোক ১৩
অষ্টমে মেরুদেব্যাং তু নাভের্জাত উরুক্রমঃ।
দর্শয়ন বর্জ্য ধীরাণাং সর্বাশ্রমনমস্কৃতম্ ।॥ ১৩ ॥
অনুবাদ
ভগবানের অষ্টম অবতার হচ্ছেন মহারাজ নাভি ও তাঁর পত্নী মেরুদেবীর পুত্র মহারাজ ঋষভদেব। এই অবতারে ভগবান পূর্ণ সিদ্ধি লাভের পন্থা প্রদর্শন করেছিলেন, যে পন্থা সর্বতোভাবে জিতেন্দ্রিয় এবং সমস্ত বর্ণ ও আশ্রমের মানুষদের দ্বারা পূজিত পরমহংসরা অবলম্বন করে থাকেন।
শ্লোক ১৪
ঋষিভির্যাচিতো ভেজে নবমং পার্থিবং বপুঃ ।
দুগ্ধেমামোষধীর্বিপ্রাস্তেনায়ং স উশত্তমঃ ॥ ১৪ ॥
অনুবাদ
হে বিপ্রগণ, ঋষিদের দ্বারা প্রার্থিত হয়ে নবম অবতারে ভগবান পৃথুরূপে রাজদেহ ধারণ করেছিলেন। এই পৃথিবীর ওষধীসমূহকে তিনি দোহন করেছিলেন। তাই পৃথিবী তখন পরম কমনীয় হয়ে উঠেছিল।
শ্লোক ১৫
রূপং স জগৃহে মাৎস্যং চাক্ষুষোদধিসম্প্লবে।
নাব্যারোপ্য মহীময্যামপাদ্বৈবস্বতং মনুম্ ॥ ১৫ ॥
অনুবাদ
চাক্ষুষ মন্বন্তরে যখন মহাপ্লাবন হয় এবং সমস্ত পৃথিবী জলের অতল তলে নিমজ্জিত হয়, তখন ভগবান মৎস্যরূপ ধারণ করে বৈবস্বত মনুকে একটি নৌকার উপর রেখে তাঁকে রক্ষা করেছিলেন।
শ্লোক ১৬
সুরাসুরাণামুদধিং মথতাং মন্দরাচলম্।
দধ্রে কমঠরূপেণ পৃষ্ঠ একাদশে বিভুঃ ।। ১৬ ॥
অনুবাদ
একাদশ অবতারে ভগবান কূর্মরূপ পরিগ্রহ করে তাঁর পৃষ্ঠে মন্দরাচল পর্বতকে ধারণ করেছিলেন, যা সমুদ্র-মন্থনকারী দেবতা এবং দানবেরা মন্থন-দণ্ডরূপে ব্যবহার করেছিল।
শ্লোক ১৭
ধান্বন্তরং দ্বাদশমং ত্রয়োদশমমেব চ।
অপায়য়ৎ সুরানন্যান্মোহিন্যা মোহয়ন্ স্ত্রিয়া ॥ ১৭ ॥
অনুবাদ
দ্বাদশ অবতারে ভগবান ধন্বন্তরিরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, এবং ত্রয়োদশ অবতারে তিনি মোহিনীরূপে অসুরদের সম্মোহিত করে দেবতাদের অমৃত পান করতে দিয়েছিলেন।
শ্লোক ১৮
চতুর্দশং নারসিংহং বিভ্রদ্দৈত্যেন্দ্রমূর্জিতম্।
দদান করজৈরূরাবেরকাং কটকৃদ্যথা ॥ ১৮ ॥
অনুবাদ
চর্তুদশ অবতারে ভগবান নৃসিংহরূপে আবির্ভূত হয়ে তাঁর নখের দ্বারা দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর সুদৃঢ় শরীর বিদীর্ণ করেছিলেন, ঠিক যেভাবে একজন সূত্রধর এরকা তৃণ বিদীর্ণ করে।
শ্লোক ১৯
পঞ্চদশং বামনকং কৃত্বাগাদধ্বরং বলেঃ।
পদত্রয়ং যাচমানঃ প্রত্যাদিৎসুস্ত্রিপিষ্টপম্ ৷৷ ১৯ ॥
অনুবাদ
পঞ্চদশ অবতারে ভগবান বামনরূপ ধারণ করে দৈত্যরাজ বলির যজ্ঞস্থানে গমন করেছিলেন। যদিও তিনি দেবতাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ত্রিভুবন অধিকার করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তবুও তিনি কেবল ত্রিপাদ ভূমি ভিক্ষা করেছিলেন।
শ্লোক ২০
অবতারে ষোড়শমে পশ্যন্ ব্রহ্মদ্রুহো নৃপান্।
ত্রিঃসপ্তকৃত্বঃ কুপিতো নিঃক্ষত্রামকরোন্মহীম্ ॥ ২০ ।॥
অনুবাদ
ষোড়শ অবতারে ভগবান ভৃগুপতিরূপে অবতীর্ণ হয়ে ক্ষত্রিয় রাজাদের দেব-দ্বিজ বিদ্বেষী দেখে তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে পৃথিবীকে একুশবার ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন।
শ্লোক ২১
ততঃ সপ্তদশে জাতঃ সত্যবত্যাং পরাশরাৎ।
চক্রে বেদতরোঃ শাখা দৃষ্টা পুংসোহল্পমেধসঃ ।। ২১ ॥
অনুবাদ
তারপর সপ্তদশ অবতারে ভগবান শ্রীব্যাসদেবরূপে পরাশর মুনির পত্নী সত্যবতীর গর্ভে আবির্ভূত হন। মানবকুলের ভিতর বুদ্ধিমত্তার স্বল্পতা দর্শন করে তিনি তাদের কল্যাণের জন্য বেদবৃক্ষের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছিলেন।
শ্লোক ২২
নরদেবত্বমাপন্নঃ সুরকার্যচিকীর্ষয়া।
সমুদ্রনিগ্রহাদীনি চক্রে বীর্যাণ্যতঃ পরম্ ॥ ২২ ॥
অনুবাদ
অষ্টাদশ অবতারে ভগবান শ্রীরামচন্দ্ররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দেবতাদের অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য তিনি সেতুবন্ধন তথা রাবণ-বধ আদি কার্য সম্পাদন করে তাঁর অলৌকিক শক্তি প্রদর্শন করেছিলেন।
শ্লোক ২৩
একোনবিংশে বিংশতিমে বৃষ্ণিষু প্রাপ্য জন্মনী।
রামকৃষ্ণাবিতি ভুবো ভগবানহরম্ভরম্ ॥ ২৩ ৷৷
অনুবাদ
ঊনবিংশতি এবং বিংশতি অবতরণে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবলরাম এবং শ্রীকৃষ্ণরূপে বৃষ্ণিকুলে (যদু-বংশে) আবির্ভূত হয়ে পৃথিবীর ভার গ্রহণ করেছিলেন।
শ্লোক ২৪
ততঃ কলৌ সম্প্রবৃত্তে সম্মোহায় সুরদ্বিষাম্।
বুদ্ধো নাম্নাঞ্জনসুতঃ কীকটেষু ভবিষ্যতি ।॥ ২৪ ॥
অনুবাদ
তারপর কলিযুগের প্রারম্ভে ভগবান ভগবদ্বিদ্বেষী নাস্তিকদের সম্মোহিত করার জন্য বুদ্ধদেব নামে গয়া প্রদেশে অঞ্জনার পুত্ররূপে আবির্ভূত হবেন।
শ্লোক ২৫
অথাসৌ যুগসন্ধ্যায়াং দস্যুপ্রায়েযু রাজসু।
জনিতা বিষ্ণুযশসো নাম্না কল্কির্জগৎপতিঃ ।। ২৫ ॥
অনুবাদ
তারপর দ্বাবিংশ অবতারে যুগ সন্ধিকালে, অর্থাৎ কলিযুগের অন্তে নৃপতিরা যখন দস্যুপ্রায় হয়ে যাবে, তখন ভগবান কল্কি অবতার নামে বিষ্ণুযশ নামক ব্রাহ্মণের পুত্ররূপে অবতরণ করবেন।
শ্লোক ২৬
অবতারা হ্যসংখ্যেয়া হরেঃ সত্ত্বনিধেদ্বিজাঃ।
যথাবিদাসিনঃ কুল্যাঃ সরসঃ স্যুঃ সহস্রশঃ ।। ২৬ ॥
অনুবাদ
হে ব্রাহ্মণগণ, বিশাল জলাশয় থেকে যেমন অসংখ্য নদী প্রবাহিত হয়, ঠিক তেমনই ভগবানের থেকে অসংখ্য অবতার প্রকাশিত হন।
শ্লোক ২৭
ঋষয়ো মনবো দেবা মনুপুত্রা মহৌজসঃ।
কলাঃ সর্বে হরেরেব সপ্রজাপতয়ঃ স্মৃতাঃ ॥ ২৭ ॥
অনুবাদ
সমস্ত ঋষি, মনু, দেবতা এবং মনুর বংশধরেরা যাঁরা বিশেষ শক্তিসম্পন্ন, তাঁরাও হচ্ছেন ভগবানের অংশ এবং কলা। প্রজাপতিরাও এই অংশ ও কলার অন্তর্গত।
শ্লোক ২৮
এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্।
ইন্দ্রারিব্যাকুলং লোকং মৃড়য়ন্তি যুগে যুগে ৷৷ ২৮ ॥
অনুবাদ
পূর্বোল্লিখিত এই সমস্ত অবতারেরা হচ্ছেন ভগবানের অংশ অথবা কলা অবতার, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং। যখন নাস্তিকদের অত্যাচার বেড়ে যায়, তখন আস্তিকদের রক্ষা করার জন্য ভগবান এই ধরাধামে অবতীর্ণ হন।
শ্লোক ২৯
জন্ম গুহ্যং ভগবতো য এতৎপ্রয়তো নরঃ।
সায়ং প্রাতর্গুণন ভক্ত্যা দুঃখগ্রামাদ্বিমুচ্যতে । ২৯ ॥
অনুবাদ
যে মানুষ মনোযোগ সহকারে ভগবানের রহস্যপূর্ণ প্রকট অর্থাৎ অবতরণের কথা সকাল এবং সন্ধ্যায় ভক্তিপূর্বক পাঠ করেন, তিনি জড় জগতের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হন।
শ্লোক ৩০
এতদ্রূপং ভগবতো হ্যরূপস্য চিদাত্মনঃ ।
মায়াগুণৈর্বিরচিতং মহদাদিভিরাত্মনি ॥ ৩০ ॥
অনুবাদ
জড় জগতে ভগবানের যে বিরাট রূপের ধারণা, তা কল্পনাপ্রসূত। তা অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের (এবং নব্য ভক্তদের) ভগবানের রূপ সম্বন্ধে ধারণা প্রদান করার জন্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভগবানের কোন প্রাকৃত বা জড় রূপ নেই।
শ্লোক ৩১
যথা নভসি মেঘৌঘো রেণুর্বা পার্থিবোহ নিলে।
এবং দ্রষ্টরি দৃশ্যত্বমারোপিতমবুদ্ধিভিঃ ।। ৩১ ।।
অনুবাদ
মেঘ এবং ধূলিকণা বায়ুর দ্বারা বাহিত হয়, কিন্তু অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা বলে যে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন এবং বায়ু ধূলাচ্ছন্ন। তেমনই, তারা আত্মায় জড় শরীরের ধারণা আরোপ করে।
শ্লোক ৩২
অতঃ পরং যদব্যক্তমব্যুঢ়গুণবৃংহিতম্।
অদৃষ্টাশ্রুতবস্তুত্বাৎস জীবো যৎপুনর্ভবঃ ॥ ৩২ ।।
অনুবাদ
এই স্থূল রূপের ধারণার ঊর্ধ্বে আরেকটি সূক্ষ্ম রূপ রয়েছে, যার কোন পরিণত রূপ নেই এবং যা দেখা যায় না, যাকে শোনা যায় না এবং যা অপ্রকাশিত। এই সূক্ষ্ম স্তরের ঊর্ধ্বে হচ্ছে জীবের স্বরূপ, তা না হলে সে বারংবার জন্মগ্রহণ করতে পারত না।
শ্লোক ৩৩
যত্রেমে সদসস্তূপে প্রতিষিদ্ধে স্বসংবিদা।
অবিদ্যয়াত্মনি কৃতে ইতি তদ্ব্রহ্মদর্শনম্ ।। ৩৩ ।॥
অনুবাদ
আত্মোপলব্ধির দ্বারা কেউ যখন হৃদয়ঙ্গম করতে পারে যে স্থূল এবং সূক্ষ্ম শরীরের সঙ্গে শুদ্ধ আত্মার কোন সম্পর্ক নেই, তখন সে নিজেকে এবং পরমেশ্বর ভগবানকে দর্শন করে।
শ্লোক ৩৪
যদ্যেষোপরতা দেবী মায়া বৈশারদী মতিঃ।
সম্পন্ন এবেতি বিদুর্মহিন্নি স্বে মহীয়তে ।। ৩৪ ৷৷
অনুবাদ
ভগবানের কৃপায় যখন মায়াশক্তির প্রভাব প্রশমিত হয় এবং জীব পূর্ণ জ্ঞানপ্রাপ্ত হন, তখন তিনি আত্মজ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হন এবং স্বীয় মহিমায় অধিষ্ঠিত হন।
শ্লোক ৩৫
এবং জন্মানি কর্মাণি হ্যকর্তৃরজনস্য চ।
বর্ণয়ন্তি স্ম কবয়ো বেদগুহ্যানি হৃৎপতেঃ । ৩৫ ॥
অনুবাদ
এইভাবে বিদ্বানেরা সেই জন্মরহিত এবং প্রাকৃত কর্মরহিত ভগবানের জন্ম এবং কর্মের বর্ণনা করেন, যা বৈদিক শাস্ত্রেও অনাবিষ্কৃত। তিনিই হচ্ছেন হৃদয়েশ্বর।
শ্লোক ৩৬
স বা ইদং বিশ্বমমোঘলীলঃ সৃজত্যবত্যত্তি ন সজ্জতেহস্মিন্।
ভূতেষু চান্তর্হিত আত্মতন্ত্রঃ ষাড়বর্গিকং জিঘ্রতি ষড়গুণেশঃ ।। ৩৬ ॥
অনুবাদ
যাঁর চরিত্র সর্বদাই নির্মল এবং নিষ্কলঙ্ক, সেই ভগবান ষড় ইন্দ্রিয়ের এবং ষড় ঐশ্বর্যের অধীশ্বর। তিনি কোনভাবে প্রভাবিত না হয়ে এই বিশ্ব সৃষ্টি করেন, পালন করেন এবং ধ্বংস করেন। তিনি প্রতিটি জীবের অন্তরে বিরাজ করেন এবং তিনি সর্ব অবস্থাতেই সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন।
শ্লোক ৩৭
ন চাস্য কশ্চিন্নিপুণেন ধাতুরবৈতি জন্তুঃ কুমনীষ উতীঃ।
নামানি রূপাণি মনোবচোভিঃ সন্তম্বতো নটচর্যামিবাজ্ঞঃ ৷৷ ৩৭ ॥
অনুবাদ
নটবৎ অভিনয়পরায়ণ পরমেশ্বর ভগবানের নাম, রূপ এবং লীলাবিলাসের অপ্রাকৃত স্বভাব বিকৃত মনোভাবাপন্ন মূর্খ মানুষেরা জানতে পারে না। তারা তাদের জল্পনা-কল্পনায় অথবা বাক্যের মাধ্যমে তা ব্যক্ত করতে পারে না।
শ্লোক ৩৮
স বেদ ধাতুঃ পদবীং পরস্য দুরন্তবীর্যস্য রথাঙ্গপাণেঃ।
যোহমায়য়া সংততয়ানুবৃত্ত্যা ভজেত তৎপাদসরোজগন্ধম্ ॥ ৩৮ ।।
অনুবাদ
যাঁরা দুরন্তবীর্য রথচক্রধারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মে অনুকূলভাবে অহৈতুকী এবং অপ্রতিহতা সেবাপরায়ণ, তাঁরাই কেবল জগতের সৃষ্টিকর্তার পূর্ণ মহিমা, শক্তি এবং দিব্য ভাব সম্বন্ধে অবগত হতে পারেন।
শ্লোক ৩৯
অথেহ ধন্যা ভগবন্ত ইত্থং যদ্বাসুদেবেহ খিললোকনাথে।
কুর্বন্তি সর্বাত্মকমাত্মভাবং ন যত্র ভূয়ঃ পরিবর্ত উগ্রঃ ।। ৩৯ ।॥
অনুবাদ
এই ধরনের প্রশ্ন করার মাধ্যমেই কেবল এই জগতে সফল হওয়া যায় এবং পূর্ণ জ্ঞান লাভ করা যায়। কেন না এই ধরনের প্রশ্ন জগৎপতি পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি অপ্রাকৃত প্রেম বিকশিত করে, এবং জন্ম-মৃত্যুর ভয়ানক আবর্ত থেকে জীবকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে।
শ্লোক ৪০
ইদং ভাগবতং নাম পুরাণং ব্রহ্মসম্মিতম্। উত্তমশ্লোকচরিতং চকার ভগবানৃষিঃ।
নিঃশ্রেয়সায় লোকস্য ধন্যং স্বস্ত্যয়নং মহৎ ॥ ৪০ ॥
অনুবাদ
এই শ্রীমদ্ভাগবত হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের বাত্ময় বিগ্রহ এবং তা সংকলন করেছেন ভগবানের অবতার শ্রীল ব্যাসদেব। তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে সমস্ত মানুষের পরম মঙ্গল সাধন করা, এবং এটি সর্বতোভাবে সার্থক, পূর্ণ আনন্দময় এবং সর্বতোভাবে পরিপূর্ণ।
শ্লোক ৪১
তদিদং গ্রাহয়ামাস 'সুতমাত্মবতাং বরম্।
সর্ববেদেতিহাসানাং সারং সারং সমুদ্ধৃতম্ ।। ৪১ ।॥
অনুবাদ
শ্রীল ব্যাসদেব সমস্ত বৈদিক শাস্ত্র এবং এই ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাসের সারতত্ত্ব আহরণ করার পর সমস্ত আত্মজ্ঞানীদের মুকুটমণিস্বরূপ তাঁর পুত্রকে তা দান করেছিলেন।
শ্লোক ৪২
স তু সংশ্রাবয়ামাস মহারাজং পরীক্ষিতম্।
প্রায়োপবিষ্টং গঙ্গায়াং পরীতং পরমর্ষিভিঃ ।। ৪২ ।॥
অনুবাদ
ব্যাসদেবের পুত্র শুকদেব গোস্বামী গঙ্গার তটে প্রায়োপবেশনে উপবিষ্ট এবং মহান ঋষিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত মহারাজ পরীক্ষিতকে শ্রীমদ্ভাগবত শুনিয়েছিলেন।
শ্লোক ৪৩
কৃষ্ণে স্বধামোপগতে ধর্মজ্ঞানাদিভিঃ সহ।
কলৌ নষ্টদৃশামেষ পুরাণার্কোহধুনোদিতঃ ॥ ৪৩ ॥
অনুবাদ
শ্রীকৃষ্ণ যখন তাঁর লীলা সংবরণ করে ধর্ম ও তত্ত্বজ্ঞান সহ নিজ ধামে গমন করলেন, তখন সূর্যের মতো উজ্জ্বল এই পুরাণের উদয় হয়েছে। কলিযুগের অন্ধকারে আচ্ছন্ন ভগবৎ-দর্শনে অক্ষম মানুষেরা এই পুরাণ থেকে আলোক প্রাপ্ত হবে।
শ্লোক ৪৪
তত্র কীর্তয়তো বিপ্রা বিপ্রর্ষের্ভূরিতেজসঃ।
অহং চাধ্যগমং তত্র নিবিষ্টস্তদনুগ্রহাৎ।
সোহহং বঃ শ্রাবয়িষ্যামি যথাধীতং যথামতি ।। ৪৪ ॥
অনুবাদ
হে তত্ত্বজ্ঞানী ব্রাহ্মণগণ, (মহারাজ পরীক্ষিতের সমক্ষে) শুকদেব গোস্বামী যখন শ্রীমদ্ভাগবত কীর্তন করেন, তখন নিবিষ্ট চিত্তে আমি তা শ্রবণ করেছিলাম, এবং তাই সেই মহান্ শক্তিশালী বিপ্রর্ষির কৃপায় আমি শ্রীমদ্ভাগবত হৃদয়ঙ্গম করেছিলাম। এখন তাঁর কাছ থেকে আমি যা শুনেছিলাম, তা আমার উপলব্ধি অনুসারে আপনাদের শোনাতে চেষ্টা করব।
ইতি-“শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত অবতারের উৎস” নামক শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধের তৃতীয় অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।
Read: চতুর্থ অধ্যায় শ্রীনারদ মুনির আবির্ভাব